বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫৬ অপরাহ্ন
পিরোজপুর : পিরোজপুরের নাজিরপুরে এসিল্যান্ড কর্তৃক তহশিলদারদের ঘুষ গ্রহনের নির্দেশের অডিও ভাইরাল হয়েছে। একই সাথে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
সম্প্রতি উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ভূমি অফিসের ইউনিয়ন ভূমি সহকারী ও উপ-সহকারী কর্মকর্তাদের (তহসিলদার) নিয়ে একটি বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে এসিল্যান্ড মো. মাসুদুর রহমানকে বলতে শোনা যায়, আপনারা যে পার কেসে ডিলিংস করেন তা এনসিওর করার কোন ওয়ে আছে? খোলামেলা কথা বলার জন্য এসিল্যান্ড তহসিলদারদের বলেন, আপনাদের মতামত শুনি যে আপনারা কি চাচ্ছেন, তিনি আরো বলেন এ ব্যাপারে আমার সাথে শাখারিকাঠী ইউনিয়ন তহসিলদার মো. শাখাওয়াত সাহেবের সাথে সব বিষয়ে কথা হয়েছে। মাটিভাঙ্গা ইউনিয়ন তহশিলদার মো. সুজন বলেন, দুই একরের বেশি জমি হলে তখন আমরা কত নিব? শ্রীরামকাঠী ইউনিয়ন তহশিলদার পরিমল বলেন, এটা স্যারের উপর নির্ভর করে। আপনি যে ভাবে বলবেন সেভাবে আমরা নিব। তখন সদর ইউনিয়নের তহসিলদার শাহজাহান কবির বলেন, সকল কেসে যেমন ১ একর, ২ একর বা ৩ একর বাতার চেয়েও বেশি জমির ক্ষেত্রে সমান হওয়া উচিত। যেমন ৫ হাজার ছিলো। সেখানে আপনি বললে ৪ হাজার টাকা নামিয়ে আনতে পারি। আপনি যেভাবে বলবেন সার। তখন এসিল্যাড বলেন, ধরেন আমি ৪ হাজার নির্ধারন করে দিলাম আপনারা কতো ড্রিল করবেন? প্রথমে মাটিভাঙ্গা ইউনিয়নের তহসিলদার মো. সুজন বলেন এখানে যদি ৪ হাজার দেয়া যায় তা হলে মোট সাড়ে ৫ হাজার হলে হয়। আমার সর্বোচ্চ ৬ হাজার টাকার বেশি নিব না। দ্বিতীয়ত নাজিরপুর সদর ইউনয়িনের তহসিলদার শাহজাহান কবির বলেন, এখানে ৪ হাজার মোট ৬ হাজার টাকা হলে হয়। তখন এসল্যিান্ড বলেন, এ অর্থ বছরের জন্য প্রতিটি নামজারি কেসের জন্য আমাকে ৪ হাজার, আপনারা ২ হাজার মোট ৬ হাজার নিবেন বলে চুড়ান্ত করে দেন। এর পর আবার এসিল্যান্ড বরেন, একচুয়ালি (বাস্তবে) আপনারা কয়টাকা নিতে চান বলেন এবং সে তার দিক থেকে প্রস্তাব করেন। আমাকে ৪ হাজার করে দেন, আপনারা দেড় হাজার মোট সাড়ে ৫ হাজার করে দেন। তখন শেখমাটিয়া ইউনিয়ন তহসিলদার মো. হাসান হাওলাদার বলেন, স্যার এটা ৬ হাজার করা হোক। এসিল্যান্ড ৬ হাজার টাকা করে প্রতিটি নামজারির জন্য চুড়ান্ত করে নির্দেশনা দেন এবং বলেন ৬ হাজার টাকার উপরে যেন না নেয়া হয়। ‘খ’ তফসিলের নামজারির কেসের জন্য এসিল্যান্ড বরেন, আমাকে ‘ক’ তফসিলের প্রতিটি কেসের জন্য ১০ হাজার টাকা করে দিবেন আর আপনারা ৫ হাজার টাকা করে নিবেন। মোট ১৫ হাজার টাকা নিবেন।
উপজেলা ভূমি অফিস সূত্রে জানা গেছে, কোন জমির মালিকানা পরিবর্তন হলে পুরানো মালিকের নাম বাদ দিয়ে নতুন মালিকের নামে নামজারি করতে সরকারী ভাবে এর ফি হিসাবে ১ হাজার ১৭০ টাকা নেয়ার নির্দেশনা রয়েছে।
উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করে বলেন, সরকারী নির্দেশনা উপেক্ষা করে দীর্ঘ দিন ধরে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ভূমি অফিস তাদের চাহিদা মতো টাকা নিচ্ছেন। কিন্তু এবার এসিল্যান্ড কর্তৃক এমনভাবে সেই ঘুষের টাকার নির্ধারন করে দেওয়ায় সেবা প্রত্যাশীরা হয়রানী বেশী হবেন।
জানা গেছে, পিরোজপুর-১ আসনের সাবেক এমপি একেএমএ আউয়াল এমপি থাকা কালে নাজিরপুর উপজেলা ভূমি অফিসের পিছনে খাস জমির উপর একটি দ্বিতল পাকা ভবন তৈরী করেন। গত ২০২০ সালের দিকে তা নিয়ে দুদকে মামলা দায়ের হলে উপজেলা ভূমি অফিস তা নিজেদের দখলে নেন। ওই ভবন সহ ৪টি ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সংস্কারের জন্য গত ৫ জুন জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ৭ লাখ ১১ হাজার ৪ শত ৬৭ টাকার টেন্ডারের মাধ্যমে ওই কাজ পাওয়া ‘ মেসার্স আহনা ট্রেডিং কর্পোরশন’ নামের এক ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। স্থানীয় সাংবাদিকদের কাছে করা এক আবেদনে জানা গেছে, এসিল্যান্ড ওই কাজ নিজে সুন্দরভাবে করার কথা বলে ঠিকাদারদের কাজ করতে দেন নি। ঠিকাদারদের মাধ্যমে কাজের টাকা উঠিয়ে তিনি নিজের একাউন্টে রাখেন। গত ২২ জুন তিনি ‘সিটি ব্যাংক’ পিরোজপুরের একটি শাখা থেকে উপজেলা ভূমি অফিসের দুই কর্মচারীর মাধ্যমে নিজ এলাকার একটি একাউন্টে ৬ লাখ ১৭ হাজার টাকা পাঠান।
সরকারী ভাবে জমির মিউটেশনের জন্য ই-নামজারি ব্যাবস্থা থাকলেও সনাতনি পদ্ধতিতে মিউটেশন করা হচ্ছে। এতে স্থানীয় ভূমি অফিসের মাধ্যমে ঘুষ-দুর্নীতর সুযোগ সহ সেবা প্রাপ্তিরা হয়রানীর শিকার হন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপজেলা ভূমি অফিসের এক কর্মচারী জানান, তিনি প্রায়ই কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই অবৈধভাবে অফিসের গাড়ি নিয়ে জেলার বাহিরে যান। গত বুধবার (১৩ সেপ্টেম্বর) ঢাকায় গেলে বিভাগীয় কমিশনারের নজরে আসে। এ নিয়ে তিনি ক্ষিপ্ত হন।
এ বিষয়ে সহকারী কমিশনার ভূমি (এসল্যিান্ড) মো. মাসুদুর রহমানের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি জানান, তিনি একটি পরীক্ষার জন্য ঢাকায় আছেন। বিষয়টি নিয়ে তাকে সাজানো ভাবে জড়ানো হয়েছে। তিনি কোন অপরাধ করেন নি বলে দাবী করেন।
অডিও কথোপকথনের বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ডাক্তার সঞ্জিব দাশ বলেন, অডিও’র কথোপকথন তিনি শুনেছেন। বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে।
পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জাহেদুর রহমান বলেন, বিষয়টি তদন্তের জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক মো. সেলিম হোসেনকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি করা হয়েছে। মঙ্গলবার থেকে কমিটি কাজ শুরু করবে। অল্প সময়ে তদন্ত কাজ শেষ করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
উল্লেখ্য, মো. মাসুদুর রহমনার গত ৮ জুন জেলার নাজিরপুরে এসল্যান্ড হিসাবে যোগাদান করেন। এর আগে তিনি সিরাজগঞ্জের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের কর্মরত ছিলেন।